থাইল্যান্ড ভ্রমণের ডায়েরি

থাইল্যান্ড ভ্রমণের ডায়েরি:
যেকোনো দেশে যাওয়ার আগে ইন্টারনেট ঘেটে খুঁটিনাটি জানার চেষ্টা করি, আর এবারও থাইল্যান্ড যাওয়ার প্ল্যান করার আগে দর্শনীয় স্থানগুলো ইন্টারনেট ঘেটে দেখার চেষ্টা করি এবং দেখি অনেক সুন্দর সুন্দর স্পট রয়েছে এবং বুঝতে পারলাম তিন-চার দিনের জন্য গেলে তেমন কিছুই দেখতে পাবো না, তাই এবারও বালি ভ্রমণের মতো ৯-১০ দিনের জন্য প্ল্যান করি, আমরা তিনজন(আমি, আমার অর্ধাঙ্গী এবং আমাদের সাড়ে চার বছরের ছেলে)

হোটেল বুকিং:
আমি বাংলাদেশ থেকেই হোটেল বুক করে গিয়েছি, agoda.com থেকে, বুকিং দিলে আপনার আগেই পেমেন্ট দিতে হয় না। হোটেল উঠার ২-৩ দিন আগে তারা চার্জ কেটে নিবে, তবে চার্জ কাটার নির্দিষ্ট তারিখের দিনে কার্ড এ ব্যালান্স থাকতে হবে। আমি আমার পেওনিয়ার মাস্টারকার্ড কার্ড দিয়ে হোটেল বুক দিয়েছিলাম। ২৫০০-৩০০০ টাকায় ভালো হোটেল পাওয়া যায় ব্রেকফাস্ট সহ। আমি টোটাল ৮ রাতের জন্য ৫ হোটেল বুক দেই। প্রথম দুই রাত ব্যাংকক প্রাতুনাম, দুই রাত ক্রাবি, একরাত ফি ফি আইল্যান্ড, একরাত ফুকেট আর বাকী দুই রাত ছিলাম পাতায়া।

ভিসা প্রসেসিং:
থাইল্যান্ডের ভিসা পাওয়া একটু কঠিন, জানিনা কি কারনে তারা প্রায়ই ভিসা রিজেক্ট করে থাকে। আমিও প্রথমবার যখন ভিসার জন্য আবেদন করি তখন আমাকে রিজেক্ট করে ছিল, এইবার পুনরায় আবার আমি যখন আবেদন করলাম তখন আমাকে তিনবার ফোন করেছিল এবং ইন্টারভিউতে ডেকেছিল। আমার সাথে কথা বলে তারা সন্তুষ্ট এবং পরদিনই জানতে পেলাম যে আমার ভিসা হয়ে গেছে। থাইল্যান্ডের ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি বিষয় খুবই জরুরী, আপনার মোবাইল ফোন সব সময় চালো রাখতে হবে। তারা যে প্রশ্ন করবে তার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবেন এবং এর বাইরে আগ বাড়িয়ে কিছু না বলাটাই ভালো। আর যদি ইন্টারভিউতে ডাকে তাহলে নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করবেন তাদের কাছে।

প্লেনের টিকিট:
ভিসা কনফার্ম হয়ে যাওয়ার পর খুব শীঘ্রই এয়ার টিকেট কনফার্ম করে ফেলি এবং ইন্টারনেট ঘেটে দেখলাম থাইল্যান্ড যাওয়ার জন্য থাই এয়ারলাইনস আমার কাছে সবচেয়ে ভাল মনে হয়েছে তাই আর বেশি না ভেবে থাই এয়ারলাইনস এর টিকেট কনফার্ম করে ফেলি এবং থাইল্যান্ডে ডমেস্টিক ফ্লাইট এর জন্য এয়ার এশিয়ার টিকেট কনফার্ম করে ফেলি।

প্রথম দিন:
আমাদের ফ্লাইট ছিল দুপুর 1 টা 40 মিনিটে, সকালের নাস্তা খেয়ে দশটার মধ্যে বাসা থেকে বের হয়ে যায় এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে এবং এক ঘণ্টার মধ্যেই এয়ারপোর্টে পৌঁছে যায়, কারণ সেদিন একুশে ফেব্রুয়ারি ছুটি ছিল তাই রাস্তাঘাট তেমন একটা যানজট ছিল না। পৌঁছেই বোডিং পাসের জন্য লাইনে দাঁড়ায়, সকাল ১১ টা বাজার কিছুক্ষণ পরে বোডিং পাস দেওয়া শুরু হয়। বোর্ডিং শেষে ইমিগ্র্যাশন ফর্ম নিয়ে তা পূরণ করে ইমিগ্র্যাশন লাইনে দাঁড়ায়। কোন ঝামেলা ছাড়াই একে একে আমাদের ইমিগ্রেশন শেষ হল। সবকিছু শেষ এইবার ফ্লাইটের জন্য রেডি কিন্তু এখনো প্রায় ২ ঘন্টার উপর সময় আছে, কি করা যাই ভেবে EBL স্কাই লাউঞ্জে গিয়ে বসি এবং সময়ও ভালো কাটলো। EBL লাউন্স থেকে বেরিয়ে এবার ফ্লাইট এর জন্য রেডি। একে একে বিমানে উঠে বসলাম। থাই এয়ারলাইন্স খুবই বিশালাকৃতির এবং ভিতরের পরিবেশটা খুবই খোলামেলা।

আমাদের ছেলে সিটে বসেই সিটবেল্ট বেঁধে সে রেডি অথচ গত বালি ভ্রমণে তাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে সিটবেল্ট বাঁধতে হয়েছিল। যাই হোক সিটে বসে আমরা গল্প করছিলাম, এই ফাঁকে একজন এয়ারহোস্টেজ এসে আমার ছেলের সাথে মজা করতে ছিল এবং তার নাম জিজ্ঞেস করছিলো এবং তাকে বলল তুমি যদি তোমার নাম বলো তাহলে আমি তোমাকে একটা জিনিস উপহার দিব। তো আমার ছেলে লজ্জা পেয়ে আর কোন কথা বলছে না। এয়ারহোস্টেজ আবার বললো যদি তুমি আমার সাথে কথা বল তাহলে আমি তোমাকে এই বইটি উপহার দিব। আর যদি কথা না বলো তাহলে এটা তুমি পাবে না, অন্য একজনকে দিয়ে দেবো। দেখি আমার ছেলের মন খারাপ, এয়ারহোস্টেজ আবার একটু ঘুরে আসলো এবং এইবার সে তার নাম বলছে আর এয়ারহোস্টেজ খুশি হয়ে তার হাতের স্টিকার বইটি আমার ছেলেকে দিলো। আমার ছেলে এবার খুশি হয়ে থাকে ধন্যবাদ জানালো এবং বইটি খুলে স্টিকার গুলো দেখতে লাগল।

যাই হোক অবশেষে বিমান উড্ডয়নের জন্য প্রস্তুত এবং এর কিছুক্ষণের মধ্যেই উড্ডয়ন করল আর কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের মাঝে খাবার দিলো, খাবারের মান খুবই ভালো ছিল। এরই ফাঁকে আমাদের মাঝে ইমিগ্রেশন ফরম দিয়ে গেল এবং তা পূরণ করে নিলাম। 2 ঘন্টা 40 মিনিট পর থাইল্যান্ডের সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্ট এ আমাদের বিমানটি অবতরণ করলো এবং আমরা থাই ইমিগ্রেশন এর কাজ সম্পন্ন করার জন্য নির্দিষ্ট স্থানে খুব দ্রুতপৌঁছে গেলাম। সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্ট এর অভ্যন্তরীণ সিস্টেমটা আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে, আপনি যদি ডান বাম একটু তাকিয়ে দেখেন এবং চোখ কান খোলা রাখেন তাহলে কারো সাহায্য ছাড়াই আপনি আপনার গন্তব্যে খুব সহজেই যেতে পারবেন। ইমিগ্রেশন অফিসার এরাইভাল সিল মেরে আমাদের হাতে পাসপোর্ট দিয়ে দিল এবং ইমিগ্রেশন ফর্ম এর একটি অংশ আমাদের পাসপোর্টে রয়ে গেছে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যখন আপনি থাইল্যান্ড থেকে ফিরবেন সেই অংশটি আপনাকে আবার পরে এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন এ জমা দিতে হবে। তাছাড়া এই অংশটি আপনার বুক করা প্রতিটি হোটেলে দেখাতে হবে। অতএব এটি যত্ন করে রাখবেন, হারাবেন না।

ইমিগ্রেশন শেষ করে এখন এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার পথে 299 বাদ দিয়ে একটি সিম কার্ড কিনে নিলাম যাতে ৮ দিনের ইন্টারনেট প্যাকেজ রয়েছে, ৭জিবি। আর থাইল্যান্ডে ইন্টারনেটের স্পিড সব জায়গায় মোটামুটি ভালই পেয়েছি।এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে, এয়ারপোর্টের নির্দিষ্ট স্থান থেকে মিটারে ট্যাক্সি ঠিক করে নিলাম এবং হোটেলে পৌঁছে গেলাম। ব্যাংককে আমাদের হোটেলটি ছিল প্রাতুনামে, এই এলাকাটি শপিংয়ের জন্য খুবই পরিচিত। হোটেলে চেক ইন করে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যার দিকে বের হয়ে পরলাম টুকটাক শপিংয়ের জন্য এবং ব্যাংকক শহরটাও একটু ঘুরে দেখলাম। তার মধ্যে Indra Market ও তার আশেপাশের স্ট্রীটমার্কেট গুলো ভাল। টুকটাক কিছুটা শপিং করে রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরে আসলাম এবং ঘুমিয়ে পড়লাম।

ব্যাংককে দ্বিতীয় দিন:
সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী আজ গ্র্যান্ড প্যালেস, গোল্ডেন মাউন্টেন এবং ব্যাংকক শহরের আশেপাশে ঘুরে দেখব। হোটেল থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটা দূরত্বে পৌঁছে গেলাম প্রাতুনাম বোট স্টেশনে, শহরের মধ্য দিয়ে একটি লেক আছে এবং এই লেক দিয়ে নৌকা চলাচল করে যা সহজে আপনি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পারবেন। লেকের পানি কিছুটা ময়লা এবং গন্ধ যুক্ত হলেও আপনি আরামসে ব্যাংককের যানজটে এড়িয়ে খুব সহজে আপনার গন্তব্যে যেতে পারবেন। প্রাতুনাম বোট স্টেশন থেকে শেষ স্টেশনে এসে নামলাম এবং আমরা গোল্ডেন মাউন্টেন টেম্পলে ২ মিনিট হাঁটা দূরত্বে পৌঁছে গেলাম। টিকিটের প্রবেশ মূল্য ২00 বাথ, গোল্ডেন মাউন্টেন টেম্পল এর উপর থেকে ব্যাংকক শহরকে খুব ভালোভাবে দেখা যায় অনেকটা আমাদের ঢাকা শহরের গুলশান/বনানীর মতোই পার্থক্য বলতে বিল্ডিংগুলোর নকশা এবং তাদের নিয়োজন।

গোল্ডেন মাউন্টেন পরিদর্শন শেষে চলে গেলাম গ্র্যান্ড প্যালেস দেখতে, এটি থাইল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যস্থানগুলোর মধ্যে একটি। এটির স্থাপত্য এবং মূল্যবান সংস্কৃতির জন্য ব্যাংককে সবচেয়ে জাঁকজমক কাঠামোর মধ্যে একটি। টিকিটের প্রবেশ মূল্য 500 বাথ। পরিদর্শন শেষে টুকটুক যোগে ব্যাংকক শহরটা দেখতে দেখতে চলে আসলাম আমাদের হোটেলের কাছাকাছি এবং দুপুরের লাঞ্চ সেরে হোটেলে গিয়ে কিছুটা বিশ্রাম নিলাম। সন্ধ্যার পর বের হয়ে গেলাম ব্যাংককের নাইট মার্কেট দেখার জন্য, যা খুবই জনপ্রিয়। নাইট মার্কেট বলতে এখানে শপিংমলে যে জিনিস গুলো বিক্রি করে সন্ধ্যার পরে সেই জিনিস গুলোই ব্যাংককের ফুটপাত থেকে আপনি সুলভ মূল্যে কিনতে পারবেন। আমরাও পছন্দমতো টুকটাক কিছু জিনিস কিনে নিলাম। শপিং শেষে ডিনারের জন্য চলে গেলাম এক ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে খাবার অর্ডার করে আমরা কথা বলছিলাম হঠাৎ আমার বউ বলল আরে আমি যে কাথ ব্যাগটা কিনেছিলাম সেটা কোথায়? যাইহোক সে ভুলে আনেনি, আমি দোকানে গিয়ে ঘটনাটি বললাম এবং দোকানদার আমায় চিনতে পেরে বললো হা নেয়নি আর ব্যাগটা আমায় দিলো। পরদিন খুব ভোরে আমাদের ক্রাবি যাওয়ার ফ্লাইট, তাই ডিনার সেরে হোটেলে গিয়ে ঘুমিয়ে পরলাম।

তৃতীয় দিন এবং আমাদের ক্রাবি ভ্রমণ:
ভোর চারটায় ঘড়ির এলাম অনুযায়ী নিজে ঘুম থেকে উঠে পড়লাম এবং রেডি হয়ে হোটেল রিসিপশনে চলে আসলাম চেক আউটের জন্য। এসে দেখি আমাদের ট্যাক্সিও হাজির, যা আগেরদিনই ঠিক করে রেখেছিলাম। আমাদের হোটেল থেকে 30 মিনিটের দূরত্বে পৌঁছে গেলাম ডন মুয়াং এয়ারপোর্টে। ডন মুয়াং ব্যাংককের খেট ডন মুয়াং নামক জায়গায় অবস্থিত প্রধান আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। দুটি টার্মিনাল নিয়ে বিমানবন্দরটি স্থাপিত। আমরা ডোমেস্টিক পোর্ট দিয়ে এয়ার এশিয়ার বোর্ডিং পাস এর জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বোডিং পাস পেয়ে ফ্লাইট এর জন্য রেডি, আমাদের ফ্লাইট এর সময় ছিল সকাল ছয়টা 40 মিনিট। নির্ধারিত গেটে এসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বিমানে চেক ইনের জন্য রেডি। একে একে আমরা বিমানে উঠে বসলাম এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লেনটি ফ্লাই করল স্বপ্নময় ক্রাবির উদ্দেশ্যে। এক ঘন্টা বিশ মিনিট পরে এয়ার এশিয়ার প্লেনটি অবতরণ করলো ক্রাবি ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দরে। এরপর এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে চলে আসলাম আমাদের পূর্ব নির্ধারিত বুক করা হোটেলে। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলের দূরত্ব ছিল ট্যাক্সি যোগে প্রায় ২৫ মিনিটের মত।

ট্যাক্সি করে যাচ্ছি আর ক্রাবির পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে ব্যাংককের কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ থেকে চলে আসলাম এক অপরূপ সৌন্দর্যের মায়াবী পরিবেশে। হোটেলে আগেই বলাছিল আমরা সকালে চেক ইন করব, যদি রুম খালি থাকে। প্রত্যাশামতো সকালের মধ্যেই রুম পেয়ে গেলাম। হোটেলটা আমার কাছে অনেকটা ডুপ্লেক্স বাড়ির মতোই মনে হলো, খুবই শান্ত পরিবেশ এবং এই হোটেল পরিচালনা করছে তিনজন নারী কর্মী। যাদের ব্যবহারে আমরা অত্যন্ত মুগ্ধ। মনে হল নিজের বাড়িতেই ছিলাম, আর রুমের ডেকোরেশনটাও ছিল খুবই নান্দনিক। হোটেলটির নাম কিস হোমটেল আর এটি নপ্পরত থারা (Nopparattara Beach) থেকে ৫-৭ মিনিটের হাটা দুরুত্ব।

হোটেলে পৌঁছে চা কফি খেয়ে চলে আসলাম Nopparattara Beach। খুবই সুন্দর যতদূর চোখ যায় যেন সাগরের বুকে ছোট ছোট পাহাড়ি টিলা আর চারিদিকে সাগর খুবই নান্দনিক পরিবেশ, দিগন্ত বিস্তৃত নীল সাগরের সাথে যেন পাহাড় আর মেঘের মিতালি। আমার ছেলে খুবই আনন্দিত সে এখন সুইমিং করবে, এখানকার সাগরের বুকে বড় বড় ঢেউ নেই খুবই শান্ত। ছেলের জন্য আগেই লাইফ জ্যাকেট কিনে রেখেছিলাম এবং সেটা পরিধান করে সে খুবই পুলকিত, কখন সুইমিং করবে, সাগরের জলে নেমে আর উঠতে চায় না, আমরা তিনজনে মিলে প্রায় দুই ঘন্টার মতো জলে ছিলাম। ছেলে তাতেও তৃপ্ত নয়, সে আরো কিছুক্ষন থাকবে অনেকটা জোর করে উঠালাম, যার উল্টো ঘটনা ঘটেছিল আমাদের বালি ট্যুরে তাকে জোর করেও সমুদ্রে নামানো যায় নি, হা হা হা।

হোটেলে ফিরে লাঞ্চ সেরে নিলাম, লাঞ্চ সেরে কিছুটা ঘুমিয়ে নিলাম এবং সন্ধ্যার পূর্বে চলে আসলাম আও নাং বিচ। সূর্যাস্ত দেখে বিচ এরিয়া কিছুক্ষণ ঘুরলাম আর ছবি তুললাম খুবই শান্ত পরিবেশ, এটি এতটা কোলাহলপূর্ণ নয়। হঠাৎ দোলনা দেখতে পেয়ে আমার ছেলে বায়না ধরল দোলনাতে উঠবে এবং দোলনাতে গিয়ে বসলো, কিছুক্ষণ পর একটি ছোট বাচ্চা মেয়েও তার সাথে গিয়ে বসলো। পাশেই তার মা ছিল এবং তারা অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছে শুধু ক্রাবিতে পাঁচ দিন থাকার জন্য। যাইহোক বিচ এর উল্টো দিকে কিছু শপিং মল রয়েছে, আমার বউ ঘুরে ঘুরে দেখল এবং টুকটাক কিছু কিনতে চাইল কিন্তু দাম শুনে সে কিছুটা হতবাক হয়ে গেল, খুবই এক্সপেন্সিভ। কাজেই এখানে শপিং করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা। কিছুটা ক্ষুধা অনুভব করলাম, ছেলেকে বললাম কি খাবে, বলে বার্গার। আর কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে এবং বার্গার কিং থেকে বার্গার খেয়ে হোটেলে ফিরে আসলাম। হোটেলে ফিরে ফোর আইল্যান্ড টুরের টিকিট কেটে ফেললাম, যারা ক্র্যাবিতে যাবেন তারা অবশ্যই এই টুরটি নিতে ভুলবেন না। থাইল্যান্ড একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম আপনি তাদের কাছ থেকে যে কোন প্যাকেজ নিতে চান না কেন সব জায়গায় একই দাম। আমার যেটা মনে হলো তাদের সবার মধ্যে একটা চুক্তি হয়েছে যার ফলে আপনি কোথাও এর কমে পাবেন না, এজন্য সব জায়গায় একই দাম।

ক্রাবিতে আমাদের অষ্টম বিবাহ বার্ষিকী পালন:
আজ আট বছরে পদাপর্ণ করে আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। দিনটি ছিল ২০১২’এর ২৩শে ফেব্রুয়ারি। তার এবং আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন। আজ থেকে সাত বছর আগে ঠিক এই দিনটিতে আমরা একে অন্যের হাত ধরেছিলাম। তাছাড়া যাওয়ার আগেই হোটেল কর্তৃপক্ষকে বলেছিলাম কেকের ব্যবস্থা করতে এবং তাদের সকল অ্যারেঞ্জমেন্টে আমার বউ অনেক সারপ্রাইজ। অসংখ্য ধন্যবাদ হোটেলের তিনজন নারী কর্মীকে। স্বপ্নময় ক্রাবিতে আমাদের অষ্টম বিবাহ বার্ষিকী যা স্মৃতি হয়ে থাকবে সারাজীবন। ঈশ্বরকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আমাদেরকে সুন্দর একটি দিন উপহার দেয়ার জন্য।

চতুর্থ দিন এবং ক্রাবিতে ফোর আইল্যান্ড ভ্রমণ:
পরদিন সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে পিক আপ ভ্যান এসে হাজির এবং আমরাও ফোর আইল্যান্ড টুরের জন্য রেডি। আপনার হোটেল বা ভিলা থেকে একটি পিকআপ ভ্যান আপনাকে নিবে, আপনি যদি ক্রবি টাউন বা ক্লং মুয়াংতে থাকেন তবে ড্রাইভার এবং গাইড প্রায় সকাল ৮:00 টার মধ্যে হোটেলে আসবে। আপনার হোটেল যদি Ao Nang হয়, তাহলে ৮:৩০ এর কাছাকাছি পিকআপ ভ্যান আসবে। পিকআপ ভ্যান গুলি প্রায় ৩০ মিনিট সময় নেয়, এর পর আমরা নপ্পরত থারা পৌঁছালাম। এখানে আমরা ছোট নৌকায় প্রায় ৯.০০ টার দিকে যাত্রা করি এবং মোট চারটি দ্বীপে গেলাম আমরা। প্রথমে আমরা প্রাণাং আইল্যান্ড যাই, খুবই পরিষ্কার জল। এই দ্বীপে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে তারপর আমাদেরকে কোহ ল্যাডিংয়ে নিয়ে যায়, যা আলস প্যারাডাইজ দ্বীপ নামেও পরিচিত। এখানে আপনি সাঁতার কাটুন বা ভাল snorkeling জন্য বিখ্যাত। যারা সাঁতার জানে তারা একে একে snorkeling এর জন্য জলে নেমে গেল তাদের সাথে আমিও নামলাম এবং খুবই এনজয় করলাম যা অনেকদিন মনে থাকবে।

তারপর আমরা গেলাম Poda Island, এখানে নেমে বুফে লাঞ্চ উপভোগ করি (নিরামিষ খাবার +চিকেন) এবং কিছুক্ষণের জন্য আবার সাগরে জলে নামি। ছেলে আমার মহা খুশি আবার জলে নেমে, তাকে আমি সাঁতার শিখাচ্ছি আর সে তার মাকে ডাক দিয়ে বলে মা এইদিকে আসো আমি তোমাকে সাঁতার শিখিয়ে দেয়, হা হা হা।

এরপর বোট আমাদের নিয়ে যায় চিকেন আইল্যান্ড, দ্বীপটি দেখতে অনেকটা চিকেনের মত হওয়ায় এর নাম চিকেন আইল্যান্ড। এখানে আমরা বোট থেকে নামিনি, তবে স্কুবা ডাইভিং এর ব্যবস্থা ছিল। সবশেষে যাই টাব আইল্যান্ডে, এক দ্বীপ থেকে সাগরের মাঝ দিয়ে আরেক দ্বীপে যাওয়ার অভিজ্ঞতাটা সত্যিই অসাধারন। টাব আইল্যান্ডে নেমে তার সৌন্দর্য দেখে যে তার বর্ণনা করবো এমন ভাষা আমার জানা নেই! সত্যিই তা কেবল নিজের চোখে দেখা ছাড়া বর্ণনা করা কঠিন।

টাব আইল্যান্ডে কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে প্রায় বিকাল ৩ টার দিকে আমরা আও নাং সমুদ্র সৈকতে ফিরে আসার জন্য আবার নৌকাতে যাই। প্রায় 4 টার দিকে বোট এসে আও নাং বিচ থামল এবং কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সেই ভ্যানযোগে আবার আমরা হোটেলে ফিরে আসলাম। সত্যি-ই অসাধারন এক অভিজ্ঞতা এবং এখানে এসে মনে হলো জীবন আসলেই উপভোগ্যময়! পরদিন সকাল ৯ টায় ফি ফির উদ্দেশ্যে যাত্রা আর এখানেই আমাদের ক্র্যাবি ভ্রমনের সমাপ্তি। এখানে ক্রাবি সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়। স্থানটি থাইল্যান্ড এর বর্ডার এলাকায়, মালয়েশিয়ার লাংকাওইর খুব কাছে বলেই এলাকাটি মুসলিম অধ্যুষিত এবং প্রায় ৫০ ভাগ মুসলিম।

পঞ্চম দিন এবং আমাদের ফি ফি আইল্যান্ড ভ্রমণ:
ক্র্যাবিকে বিদায় জানিয়ে এবার আমাদের গন্তব্য ফি ফি আইল্যান্ড। ফেরি ঘাটে এসে তাদের ফেরিঘাট দেখে আমি কিছুটা অবাক এ যেন একটা মিনি এয়ারপোর্ট, খুবই ভালো সুযোগ-সুবিধা। 9 টা বাজার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফেরি ছেড়ে দিল আর তরতর করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, যেন নীল সাগরের বুক চিরে এগিয়ে চলল আমাদের ফেরি।

ফেরির ছাদ থেকে এই নয়নাভিরাম দৃশ্য অবলোকন সত্যিই কখনো ভুলার নয়, এ যেন কল্পনায় ছোটবেলায় টিভিতে দেখা সিন্দাবাদের সওদা করতে যাওয়ার দৃশ্য। দেখতে দেখতে প্রায় দুই ঘন্টা পর ফেরি এসে ভিড়ল ফি ফির ঘাটে। ফেরি থেকে নেমে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি এবং দেখি সবাই যার যার হোটেলের ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু সামনে যেতেই আমাদের বুক করা হোটেলের ব্যানার টি পেয়ে গেলাম, ফি ফিতে আমাদের হোটেলের নাম ছিল “The Cobble Beach Hotel” হোটেল কর্তৃপক্ষের লোক আমাদের ব্যাগ গুলো নিয়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার জন্য বলে কারণ এই ফেরিতে তাদের হোটেলের আরো লোকজন ছিল। সবাই একসাথে জড়ো হওয়ার পর সে হাত চালিত একটি দুই চাকার ভ্যানে আমাদের সবার ব্যাগ গুলো নিয়ে তার পিছন পিছন যেতে বলল। সবাই এগিয়ে যাচ্ছে আর আমরা কিছুটা পিছিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম আমাদের ছেলের কারণে, এই অবস্থা দেখে হোটেলের লোকটি আমার ছেলেকে ভ্যানের উপর বসিয়ে দিল এবং যেতে লাগলো। প্রায় 15 মিনিট হেঁটে অবশেষে হোটেলে চেক ইন করলাম। হোটেলে চেক ইন করে ক্রাবি থেকে নিয়ে আসা পাউরুটি, আম খেয়ে নিলাম আমরা তিনজন মিলে। তাছাড়া আমি প্রায়ই থাইল্যান্ডের লোকাল মার্কেট থেকে শপিং করতাম বিভিন্ন খাবারের জন্য যেমন ফল, ওয়াটার এবং প্রয়োজনীয় আরো কিছু। এতে আপনার খরচ কিছুটা হলেও সাশ্রয়ী হবে।

কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে নেমে পড়লাম সাগরের বুকে, এমন স্বচ্ছ জল আমি এর আগে কোথাও কোনো সৈকতে দেখিনি। কোমর সমান জলে দাঁড়িয়েও স্পষ্ট সাগরের তলদেশ দেখা যাচ্ছিলো। রুমে ফিরে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিলাম। সন্ধ্যায় বের হলাম দ্বীপ প্রদক্ষিনে, পাহাড়ে ঘেরা আর নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্যে ঘেরা ছোট্ট একটি দ্বীপ ফি ফি। আপনি পায়ে হেঁটেই দ্বীপটি প্রদক্ষিণ করতে পারবেন, সর্বোচ্চ ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিনিট লাগতে পারে । এখানে কোন যানবহন নেই, তাই আপনার পা দুটিই একমাত্র ভরসা। দুপুরে যে রেস্টুরেন্টে খেয়েছিলাম সেই রেস্টুরেন্টেই ডিনার সেরে হোটেল রুমে ফিরে আসলাম। পরদিন সকাল 9 টায় আমাদের ফুকেট যাত্রা কিন্তু ফি ফির সৌন্দর্য দেখে ঠিক করলাম সকাল এর পরিবর্তে দুপুরের ফেরিতে যাব। একই কোম্পানির ফেরি টিকিটে আপনি যেকোনো টাইমে যেতে পারবেন, আমি আমি যে ফেরির টিকেট কেটেছিলাম তাদের টাইম ছিল সকাল 9 টা, ১১ টা আর দুপুর 2 টা।

ষষ্ঠ দিন এবং আমাদের ফুকেট ভ্রমণ:
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফি ফির সৌন্দর্য উপভোগের জন্য সৈকতের বালুচরে হেঁটে বেড়ালাম আর অনেক ছবি তুললাম। আমাদের এই হোটেলের সুইমিং পুল এবং রেস্টুরেন্ট এর স্থানটি ছিল এক কথায় অসাধারণ। ব্রেকফাস্ট সময় বা সুইমিংপুল থেকে ফি ফির প্রকৃতির সৌন্দর্য অবলোকন করার মুহূর্তটি সারা জীবন মনে থাকবে। সত্যিই পুরো দ্বীপটি বিধাতা যেন ছবির মত করে সাজিয়েছে। কেউ যদি আমাকে কখনো জিজ্ঞেস করে আপনার থাইল্যান্ড ট্যুরের সবচেয়ে স্মরনীয় মুহুর্ত কোনটি, আমি বলব ফি ফিতে কাটানো একটি রাত, যা কখনো ভুলার নয়। দুপুর নাগাদ ফি ফি কে বিদায় জানিয়ে ফেরিতে উঠে বসলাম, এবার গন্তব্য ফুকেট। আবার প্রায় দুই ঘন্টা পর ফেরি ফুকেটের তীরে এসে পৌঁছলো। মনে হচ্ছে আবার যেন কোলাহলপূর্ন নগরীতে ফিরে এলাম। ফেরিতে থাকা অবস্থায়ই হোটেলে যাওয়ার টিকেট করে নিলাম। ফুকেটে আমাদের হোটেলটি পেতং বিচের কাছেই ছিল। বিকেলের মধ্যে হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে গেছে চলে আসলাম পেতং বিচে সূর্যাস্ত দেখব বলে, সূর্যাস্ত দেখে কিছুটা সময় কাটিয়ে পেতং শহরটা একটু ঘুরে দেখলাম। আগেই প্ল্যান ছিল ফুকেটে একদিন থাকবো, পরদিন সকালে আবার ব্যাংককের ফ্লাইট। এই কয় দিনে সাগর, পাহা্ড়, দ্বীপ যথেষ্ট দেখেছি, তাই আবার আমার ছেলের জন্য ঘুরে বেড়াবো।

সপ্তম দিন এবং আমাদের সাফারি পার্কে ভ্রমণ:
সকালে ঘুম থেকে উঠেই ট্যাক্সি যোগে চলে গেলাম ফুকেট এয়ারপোর্টে। সেখান থেকে এয়ার এশিয়ার ফ্লাইটে পৌঁছে গেলাম ডন মুয়াং। এরপর এয়ারপোর্ট থেকে আবার ট্যাক্সি যোগে সরাসরি আসলাম ব্যাংকক সাফারিপার্কে। ড্রাইভার ট্যাক্সি থেকে নামার পর জিজ্ঞেস করলো, আপনারা সাফারি পার্ক দেখার পরে কোথায় যাবেন, আমি বললাম এইখানে সাফারি পার্ক এবং সাফারি ওয়ার্ল্ড দেখতে যতক্ষণ লাগে তারপর এখান থেকে আমরা সরাসরি যাব পাতায়া। তার কথা বুঝতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছিল তারপর সে একজন ইংরেজি জানা লোকের সাথে কথা বলিয়ে দিল। কথা বলে আমি বুঝতে পারলাম সে আমাদের পাতায়া নিয়ে যেতে রাজি কিন্তু সে দুই হাজার বাথ ভাড়া দাবি করে। অবশেষে দামাদামি করে ডন মুয়াং এয়ারপোর্ট থেকে সাফারি পার্ক আসা + পাতায়া পর্যন্ত সে পনেরশো বাথে রাজি হলো। উল্লেখ্য ব্যাংকক শহর থেকে পাতায়ার দূরত্ব ১৬০+ কিঃমিঃ।

অবশেষে সাফারি পার্কে প্রবেশ করি, এখানে এক শো শেষ হলে দর্শক পায়ে হেটে চলছে আরেকটি গেম শো দেখতে। এভাবে চলে সী লায়ন শো, ডলফিন শো, কাউবয় শো, এ্যালিফেন্ট শো, বার্ড শো,স্পাই ওয়ার শো। আমার ছেলেতো মহাখুশি আর সবচেয়ে সে মজা পায় জিরাফকে কলা খাহিয়ে এবং সাফারি ওয়ার্ল্ডে উন্মুক্ত অবস্থায় পশুপাখিদের বিচরণ দেখে। যেখানে দেখা যায় সি লায়ন ও ডলফিনগুলো দর্শকদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিচ্ছে। দেখাচ্ছে নানা শারীরিক কসরত, ডিগবাজি। পুলের এক প্রান্ত থেকে পিঠে মানুষ নিয়ে ছুটে চলেছে অন্য প্রান্তে। সুরের তালে তালে চলছে কখনো একক আবার কখনোবা দলীয় নৃত্য।

ঘুরতে ঘুরতে কিছুটা ক্লান্ত, লাঞ্চ সেরে বিকাল ৩ টা নাগাদ ট্যাক্সিতে উঠে বসলাম, গন্তব্য এবার পাতায়া। পাতায়া যাওয়ার রাস্তা দেখে আমি কিছুটা অবাক বাম দিকে চার লেন ডানদিকেও চার লেন। পুরো থাইল্যান্ডের ট্রাফিক ব্যবস্থা উন্নতমানের, রাস্তায় কোনো গাড়ির হর্নের শব্দ নেই, সবাই সয়ংক্রিয় সিগন্যাল মেনে গাড়ি চালাচ্ছে। পাতায়ার পথে আমাদের ট্যাক্সি ১১০-১২০ কিঃমিঃ গতিতে চলছে অনবরত। আর আমার ছেলে ট্যাক্সিতে উঠার কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘুমে, সারাবেলা সাফারি পার্ক ঘুরে ক্লান্ত। আর তার কথা ভেবেই প্রায় সময় ট্যাক্সি নিতাম এবং প্রায়সময় গাড়িতেই সে একটা ঘুম দিতো, তার জন্য গাড়িতে সবসময় খাবার রাখতাম, তবে এবার বালি ট্যুরের চেয়েও সে খুব মানিয়ে নিয়েছে। ওভারঅল খুব উপভোগ করেছে।

প্রায় দুই ঘন্টার মধ্যে আমরা পাতায়া পৌঁছে গেলাম এবং হোটেলে চেক ইন করলাম। দেখি ছেলের কিছুটা মন খারাপ তার হোটেল রুম দেখে পছন্দ হয়নি, ক্রাবি এবং ফুকেটের হোটেল রুমটি তার খুবই পছন্দ হয়েছিল। আমার বৌয়েরও কিছুটা পছন্দ হয় নি, তাই রিসিপশনে আসলাম বললাম অন্য কোন রুম দেয়া যায় কিনা এই রুমের পরিবর্তে। তারা বলল দেয়া যাবে তবে কিছুটা বাড়তি পেমেন্ট করতে হবে আমি বললাম কত? বলল আপনারা এখানে থাকবেন দুই রাত তার জন্য আরও ৬০০ বাথ দিতে হবে। মনে মনে ভাবলাম এটাই আমাদের শেষ হোটেল তাই আর কিছু চিন্তা না করে বললাম ঠিক আছে, আর তারাও ডিলাক্স রুমে শিফট করে দিলো। এই রুম পেয়ে ছেলে খুশি, ছেলের মাও খুশি আর সেই খুশিতে আমিও খুশি হাহাহা। 😀

ফ্রেশ হয়ে কিছুটা বিশ্রাম নিলাম, সন্ধ্যার একটু পর বের হলাম আজ প্রায় সারাদিন সাফারি পার্কে হেঁটে পা দুটো ব্যথা করছে, তাই বউ জামাই মিলে চলে এলাম ম্যাসেজ পার্লারে ফুট ম্যাসাজ নিতে। কিছুক্ষণ পাতায়া সিটি ঘুরে রাতের ডিনার সেরে হোটেলে এসে ঘুমিয়ে পড়লাম।

অষ্টম দিন এবং আমাদের পাতায়ার বিভিন্ন স্থানে ঘুরাঘুরি:
হোটেল থেকে ব্রেকফাস্ট সেরে রেডি হয়ে গেলাম প্ল্যান অনুযায়ী আজকে পাতায়া শহর ও তার আশেপাশের কিছু দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখব।প্রথমেই পাতায়া বিচে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে কিছু ছবি তুললাম, সেখান থেকে ভ্যানে করে চলে গেলাম আর্ট গ্যালারিতে এবং অনেকক্ষণ সময় কাটালাম আর অনেক ছবি তুললাম, খুবই এনজয় করেছে আমার ছেলে। সেখান থেকে ট্যাক্সি নিলাম আর যাচ্ছি মিনি সিয়ামের পথে, লেডি ট্যাক্সি ড্রাইভার, ট্যাক্সি করে যাচ্ছি আর সে আমাদের ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল আমরা আর কোথায় কোথায় যাব কয়দিন পাতায়াতে থাকব ইত্যাদি। বললাম আমরা আগামীকালই চলে যাচ্ছি। সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্ট হয়ে ডিরেক্ট আমাদের ফ্লাইট ব্যাংকক সময় রাত 11 টা, সে বললো তুমি রাজি থাকলে আমার ট্যাক্সি ভাড়া করতে পারো, আমি যাব না আমার এক ছেলে বন্ধু তোমাদের নামিয়ে দিবে। তো দরদামের একপর্যায়ে সে ১০০০ বাথ চাইলো, আমার আগে একটা আইডিয়া ছিলো দাম নিয়ে আমি বললাম ৮০০ বাথ, শেষ পর্যন্ত ৯০০ বাথে রাজি হলো। ১০০ বাথ অগ্রিম নিয়ে সে আমাকে একটা স্লিপ দিয়ে দিল এবং যে ড্রাইভার আসবে তার নাম্বার দিয়ে বলল উনার সাথে যোগাযোগ করতে, আমি বললাম ঠিক আছে আমরা সন্ধ্যা ৬ টায় রওনা দিবো।

তার থেকে বিদায় নিয়ে আমরা মিনি সিয়ামে প্রবেশ করলাম, মিনি সিয়ামের পরিবেশটা খুবই চমৎকার এখানে এখানে বিভিন্ন দেশের জনপ্রিয় স্থাপনাগুলো নিয়ে এক একটি ছোট্ট দেশ গড়ে তোলা হয়েছে বেশির ভাগই ইউরোপীয় মহাদেশের। একটি গাছের ছায়া থেকে ছেলেকে কিছু স্থাপনা দেখাচ্ছিলাম হঠাৎ দেখি আমার মাথার উপর কি যেন পরলো, উপরে তাকিয়ে দেখি জাম গাছ আর আমার মাথায় একটি পাকা জাম পড়েছে। নিচেও তাকিয়ে দেখি অনেক পাকা জাম পড়ে আছে, লোভ সামলাতে না পেরে কয়েকটি কুড়িয়ে খেলাম, খুবিই টেস্ট আর বুঝলাম থাইল্যান্ডে এখন ভরপুর গ্রীষ্মকাল তাই এত গরম হা হা হা।

দুপুর পর্যন্ত আমি মিনি সিয়ামে সময় কাটিয়ে চলে আসলাম পাতায়া শহরে, সেখান থেকে লাঞ্চ সেরে হোটেল রুমে এসে বিশ্রাম নিলাম। ঘুরাঘুরি তো অনেক হল এবার শেষ পর্যায়ে কিছু শপিং করার পালা, সন্ধ্যার পর চলে গেলাম পাতায়া নাইট মার্কেটে। ঘুরে ঘুরে দেখলাম এবং কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নিলাম। ডিনার সেরে হোটেলে ফিরলাম।

৯ম দিন এবং আমাদের রিটার্ন ফ্লাইট:
সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট করতে গেলাম আর আমার ভার্সিটি লাইফের এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেল। প্রায় 10 বছর পর বন্ধুর সাথে দেখা প্রথমে চিনতে পারিনি তারপর দূর থেকে তার নাম বলে ডাকলাম দেখি সে আমার ডাকে সারা দিচ্ছে। ব্রেকফাস্ট করতে করতে অনেকক্ষণ গল্প করলাম আর সময়টাও ভালোই কাটলো। ধীরেসুস্থে দুপুর 12 টার মধ্যে হোটেল থেকে চেক আউট করলাম, হোটেল লবিতে আমাদের লাগেজ গুলো রেখে চলে আবারও চললাম টুকটাক শপিং করতে। শপিং শেষে লাঞ্চ করতে গেলাম, পাতায়াতে যে দুই দিন ছিলাম এক ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে খেয়েছিলাম, রেস্টুরেন্টের মালিকও এক ইন্ডিয়ান। সে প্রায় 18 বছর ধরে থাইল্যান্ডে থাকে তার বাসা এবং রেস্টুরেন্ট একই বিল্ডিংয়ে। খাবারের মান ও দাম খুবই ভালো আর তাদের সাথে খাতিরও খুব ভালো জমে গিয়েছিল। ওরাও জানে আজকে আমাদের থাইল্যান্ডে শেষ দিন তাই আমাদের খুবই ভালো আপ্যায়ন করলো।

লাঞ্চ সেরে আবার হোটেলে ফিরে আসলাম এবং শপিং করা জিনিস গুলো গুছিয়ে নিলাম। পাতায়া বিচে এসে চেয়ার ভাড়া করে নিভৃতে তিনজন মিলে সময় কাটালাম বিকাল পর্যন্ত। বিকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আগেই ভাড়া করা ট্যাক্সি এসে হাজির। আমরাও উঠে রওনা হলাম সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্ট এর উদ্দেশ্যে। রাত সাড়ে আটটার দিকে সুবর্ণভূমি এসে পৌছালাম এবং বোর্ডিং পাস নিয়ে নিলাম। বোডিং শেষে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম ইমিগ্রেশনে। একে একে হয়ে গেলো ইমিগ্রেশন। সবকিছু শেষ এইবার ফ্লাইটের জন্য রেডি কিন্তু এখনো প্রায় ২ ঘন্টার উপর সময় আছে, কি করা যায় ভেবে আমার স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক এর প্রায়োরিটি পাস কাজে লাগালাম, প্রায়োরিটি পাস দেখিয়ে Miracle First Class Lounge সময় কাটাই ফ্লাইটের আগ পর্যন্ত।

সবশেষে, সত্যি বলতে কি এই কয়দিনের ঘুরাফেরাই থাইল্যান্ডের প্রেমে পরে গিয়েছিলাম। থাইল্যান্ডের মানুষও আমাদের দেশের মতো অনেকটা অতিথি পরায়ন, থাইল্যান্ডে যত জায়গায় গিয়েছি এবং যত শপিংমলে গেলাম সবাই খুব ভালো ব্যবহার করেছে। মনে মনে ঠিক করলাম আবার যদি থাইল্যান্ড আসি তাহলে নেক্সট টাইম শুধু ফুকেট এবং ফি ফি আইল্যান্ড সময় কাটাবো, কারণ এবার ফুকেটে তেমন একটা ঘোরা হয়নি। আর ফি ফি আইল্যান্ড এর স্মৃতি আমার মনে চির অম্লান হয়ে থাকবে।


খরচাপাতি
:
এই ৯ দিনে শপিংবাদে আমাদের তিনজনের প্রায় 2 লক্ষ ২0 হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে।

প্লেন ফেয়ার: ৬০ হাজার (ঢাকা-ব্যাংকক-ঢাকা, থাই এয়ারলাইন্স)

ইন্টারন্যাল প্লেন ফেয়ার: ২৫ হাজার টাকা, খাবার +ল্যাকেজ খরচসহ (ব্যাংকক-ক্রাবি এবং ফুকেট-ব্যাংকক, এয়ার এশিয়া)

হোটেল খরচ: প্রায় ৩৫ হাজার টাকা।

ফেরি ভাড়া: ৪ হাজার টাকা (ক্রাবি-ফি ফি-ফুকেট)

ইন্টারন্যাল রোড ট্রান্সপোর্ট: প্রায় ৩০ হাজার টাকা।

একটিভিটিস + টিকেট মূল্য: প্রায় ২৩ হাজার টাকা।

বাদবাকী খরচ: খাবার + অন্যান্য।

নোট:
দয়াকরে সব জায়গায় ভদ্রতা বজায় রাখুন আর প্লাস্টিক, পলিথিন ও অপচনশীল জিনিস এখানে সেখানে ফেলবেন না। প্রকৃতি পরিস্কার রাখার দায়িত্বও আপনার আমার সকলের। মনে রাখবেন ধনী-গরীব যেই হোক না কেন প্রকৃতির কাছে আমরা সবাই সমান।

থাইল্যান্ড ভ্রমণের ডায়েরি

5 thoughts on “থাইল্যান্ড ভ্রমণের ডায়েরি

Write a comment....

Scroll to top
error: Content is protected !!